স্বেচ্ছায় রক্ত দানের ৭টি উপকারিতা
ইংরেজ চিকিৎসক ডাঃ উইলিয়াম হার্ভে ১৬১৬ সালে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহিত হয়। এর অনেক পরে ডাঃ জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ১৮১৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা দিয়ে সর্বপ্রথম সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। এভাবেই মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার শুরু এবং এরপর থেকেই মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে অসংখ্য অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে সুস্থ করা হয়ে আসছে।
কারা রক্ত দানের জন্য উপযুক্তঃ ১৮-৬০ বছরের সুস্থ সবল যে কোন ব্যাক্তির ওজন যদি ন্যুনতম ৪৮ কেজি হয় তবে তিনি রক্ত দানের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হন।
রক্ত দিলে শারীরিক কোন ক্ষতি হয় কি? রক্তদানে শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। ছেলেদের শরীরে ওজনের কেজি প্রতি ৭৬ মিলিলিটার আর মেয়েদের শরীরে ওজনের ৬৬ মিলিলিটার করে রক্ত থাকে এবং সবারই কেজি প্রতি ৫০ মিলিলিটার রক্ত সংবহনের জন্য প্রয়োজন হয়, বাকিটা থাকে উদ্বৃত্ত। অর্থাৎ ছেলেদের ওজনের কেজি প্রতি ২৬ মিলিলিটার আর মেয়েদের ওজনের কেজি প্রতি ১৬ মিলিলিটার রক্ত থাকে উদ্বৃত্ত। ফলে ৫০ কেজি ওজনের একটি ছেলের শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ ৫০*২৬=১৩০০ মিলিলিটার আর একই ওজনের একজন মেয়ের শরীরে উদ্বৃত্ত রক্তের পরিমাণ ৫০*১৬=৮০০ মিলিলিটার । আর স্বেচ্ছা রক্তদানে একজন রক্ত দাতার কাছ থেকে মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত সংগ্রহ করা হয়। তাই রক্তদানে শারীরিক কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনাই নেই। আর একজন সুস্থ লোক প্রতি চারমাস পরপর রক্ত দান করতে পারেন। মানুষের শরীররে রক্ত উপাদান গুলি প্রতি চার মাস পর এমনিতেই নষ্ট হয়ে নতুন রক্ত উৎপাদিত হয়। তাই রক্ত দান করলে শরীরের ক্ষতি তো হয়ইনা বরং আছে অনেক উপকার।
স্বেচ্ছায় রক্ত দানের মানসিক ভাবেও আছে অনেক উপকার এবং ধর্মীয় দিক থেকে অত্যান্ত পুণ্যের।
শারীরিক উপকারিতাঃ বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল এটাই যে রক্ত নিয়মিত রক্ত দান স্বাস্থের জন্যে শুধু উপকারিই নয় বরং নিয়মিত রক্ত দিলে একজন মানুষ মুক্ত থাকতে পারেন বেশ কয়েকটি মারাত্মক রোগের ঝুঁকি থেকে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমেঃ মিলার-কিস্টোন ব্লাড সেন্টারের এক গবেষনায় দেখা যায়, নিয়মিত রক্ত দিলে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্ত দাতাদের ক্ষেত্রে অন্যান্যদের চেয়ে অনেক কম থাকে। হৃদরোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমেঃ নিয়মিত রক্তদানে হৃদযন্ত্রের সামগ্রীক উন্নতি হয়। রক্তে যদি লৌহের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে তাহলে কোলেস্টেরলের অক্সিডেশনের পরিমাণ বেড়ে যায়, ধমনী ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ফলাফল হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত রক্ত দিলে দেহে লৌহের পরিমাণ কমে যায় যা, হৃদরোগের ঝুঁকিকেও কমিয়ে দেয় কার্যকর ভাবে। যারা নিয়মিত রক্ত দেন তাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অন্যদেও চেয়ে ৮৮ ভাগ কমে যায় এবং স্ট্রোকসহ অন্যান্য হৃদ রোগের ঝুঁকি কমে যায় ৩৩ ভাগ।
অতিরিক্ত ক্যালরি ক্ষয় নিয়মিত রক্তদানে শারীরিক ফিটনেস বাড়ে। ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত দান করলে রক্ত দাতার দেহ থেকে ৬৫০ ক্যালরি পুড়ে। তাতে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে এবং ডায়াবটিসের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়াও নিয়মিত রক্ত দান করলে কোন দুরারোগ্য ব্যাধি শরীরে দানা বাঁধতে পারে না তাই উচ্চরক্তচাপ সহ যে কোন কঠিন রোগ থেকে থাকা যায় নিরাপদ।
প্রানবন্ততা এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিঃ রক্ত দান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের ব্যোন ম্যারো নতুন কনিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। রক্ত দান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। আর লোহিত কনিকার ঘাটতি পূরণ হয়ে যায় ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যেই। আর এই প্রক্রিয়া আমাদের শরীরের সার্বিক সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা কেই বাড়িয়ে দেয়।
নিজের সুস্থতা পরীক্ষাঃ রক্ত দান করার মাধ্যমে একজন রক্ত দাতা তার সার্বিক সুস্থটাকে যাচাই করে নিতে পারেন । হেপাটাইটিস বি, সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া এবং এইডস এই পাঁচটি রোগের স্ক্রিনিং রিপোর্ট পাওয়া যাবে বিনামুল্যে, যা করতে যে কোন সাধারণ মানের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কমপক্ষে কয়েক হাজার টাকা খরচ হবে। এভাবে বছরে তিনবার রক্তদান আপনার সার্বিক সুস্থতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। রক্ত শারীরিক উপকার ছাড়াও আছে মানসিক উপকার ও অত্যান্ত পুণ্যের কাজ।
চারজন রোগীর জীবন দানঃ রক্তের অপরিহার্য চারটি উপাদান হচ্ছে লোহিত কনিকা, শ্বেতকনিকা ,অণুচক্রিকা ও প্ল্যাটিলেট। একজন রক্তদাতার দেহ থেকে রক্ত সংগ্রহের পর এই চারটি উপাদান পৃথক করে চারজন রোগীকে প্রদানের মাধ্যমে চারজন রোগীর প্রান রক্ষা করা হয়।
অত্যান্ত পুণ্যের কাজঃ রক্ত দান ধর্মীয় দিক থেকে অত্যান্ত পুণ্য বা সওয়াবের । পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে “ যে ব্যাক্তি একজন মানুষের জীবন রক্ষা করল সে যেন সমগ্র মানব জাতির জীবন রক্ষা করল” ( সূরা মায়েদাঃ ৩২)। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন একজন খারাপ মহিলাকে শুধুমাত্র পিপাসারত মৃত্যু পথযাত্রী কুকুরকে পানি পান করানোর মাধ্যমে প্রান রক্ষা করার জন্য ক্ষমা ও জান্নাত দান করতে পারে তবে, রক্তদানের মাধ্যমে চারজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য আপনাকে আমাকে আরো বড় পুরস্কার অবশ্যই দিতে পারেন।
আপনি কি জানেন, প্রতি বছর আমাদের দেশে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যত স্স্থু সমর্থ মানুষ আছেন, তারা যদি শুধু জন্মদিনেই রক্ত দেন, তাহলেই আমাদের দেশের পুরো রক্তের চাহিদা স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। তাই আপনার প্রতিটি জন্মদিন বরণ করুন রক্তদান করে। পৃথিবীতে আপনার আগমনের এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখুন আরো ৪ টি প্রান বাঁচানোর মাধ্যমে। নিজ পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করুন রক্তদানের মাধ্যমে আপনার শুভ জন্মদিনকে উদযাপন করতে।
এডমিন।