প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম আর নিরন্তর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ, আমরা যাকে এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নামে চিনি। একদা যা সমতটের অংশ, পরে তা পরিচিতি পেল বৃহত্তর খুলনা নামে। পলিমাটিতে গড়ে ওঠা প্লাবনভূমির সরকাদার মতোই নরম মানুষের মন, জোয়ারভাটার সাথে চলে তার ধীরলয়ের জীবন। কিন্তু ঠিক সময়ে তা ফুঁসে ওঠে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো, কেননা ন্যায্য অধিকার তার ছিনে নেয় বারবার। তাই দক্ষিণাঞ্চল বরাবরই সংগ্রামের, দ্রোহের, অবিরাম লড়াইয়ের ক্ষেত্র। লক্ষণ সেনের অত্যাচারে পৌণ্ড্র থেকে অন্ত্যজ জনগোষ্ঠী এখানে এসে যেমন ‘পোঁদ’ নাম নিয়েছে, তেমনি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে লক্ষণ সেনও আশ্রয় নিয়েছেন এই দক্ষিণ বাংলায়। মুণ্ডিত মস্তকের বৌদ্ধ শর্মণগণ মুসলমানিত্ব গ্রহণ করে এখানেই অভিবাসী হয়েছে, নিজের নাম নিয়েছে ‘নেড়ে’।
বহু সংস্কৃতির এই মিলন আমাদেরকে দিয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা আর যূথবদ্ধ লড়াইয়ের প্রেরণা। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা খালবিল, জলাভূমি, নদীনালা আর নোনাজলের মাছ মিলে যে যে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো সেখানে শাসন আর বাণিজ্য হানা দিয়েছে বহুবার। তাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নদীতে যেমন বাঁধ দেয়া হয়েছে, তেমনি লাখো মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঁধ কেটেও দেয়া হয়েছে, সময়ের প্রয়োজনে। নদীর বুকে জমা পলি যেমন জীবন কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের, তেমনি পলি দিয়ে গড়ে ওঠা চর ও খাসজমির অধিকার রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে মানুষ।
মানুষের সংগ্রাম এগিয়ে নিতে এই মাটি থেকেই উঠে এসেছে মানুষের নেতৃত্ব। ব্রিটিশ অপশাসন, মুক্তিসংগ্রাম, খাসজমি, জলাবদ্ধতা, চিংড়িচাষ, বাঁধ কাটা কিংবা গড়ে তোলা শিশুসঙ্ঘ, ছাত্র সংগঠন বা রাজনৈতিক আন্দোলন, সবখানে এই মানুষদের পদচ্ছাপ আমাদের যাত্রাকে সাবলীল করেছে। কৃতজ্ঞ আমরা তাঁদের কাছে। তাঁদের স্মরণ করতে চাই প্রতিটি পদক্ষেপে। তবে, কেশবপুরের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ ‘ভরতের দেউল’ কিংবা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরের মতোই আন্দোলনের ইতিহাস চাপা পড়ে যায় সময়ের পলিমাটির নিচে। পলি খুঁড়ে বের করতে হবে সেই লড়াইয়ের ইতিহাস। তাই আমাদের এ উদ্যোগ।